কালারাজা বাজার ও গ্রামের নামকরণের ইতিহাস!
পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার চিকনিকান্দি ইউনিয়নের একটি গ্রাম কালারাজা, এই গ্রামের গ্রামীণ অর্থনীতি ও রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হল কালারাজা বাজার। কালারাজা বাজার ও গ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের প্রাচীন সমৃদ্ধ ইতিহাস আর ঐতিহ্যের স্মৃতি।
বর্তমান বাকেরগঞ্জ, পটুয়াখালী, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, কোটালীপাড়া ও বাগেরহাটের পূর্বাংশ নিয়ে গঠিত ছিল প্রাচীন বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য।
বাকলা চন্দ্রদ্বীপের রাজা ছিলেন জয়দেব। জয়দেব মারা যাওয়ার পর সিংহাসনে আরোহণ করেন তার মেয়ে কমলা সুন্দরী। পাঁচ শ’ বছর আগে সুপেয় পানীয়জলের জন্য বিশাল দীঘি খননসহ রাজ্য শাসন ও প্রজা পালনে কল্যাণকর ভূমিকার জন্য দক্ষিণাঞ্চলে কিংবদন্তিতে রূপ নিয়েছেন চন্দ্রদ্বীপের প্রথম বাঙালী নারী শাসক রাজকুমারী কমলা দেবী।
রানী কমলা ছিলেন চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের ষষ্ঠ শাসক। তার বাবা জয়দেবের কোন পুত্রসন্তান ছিল না। দুই বোনের মধ্যে সর্বাধিক যোগ্য কমলা ১৪৯০ খ্রিস্টাব্দে চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ছিলেন চন্দ্রদ্বীপের প্রথম বাঙালী নারী শাসক।
তবে রাজ্যের দায়িত্ব নেয়ার আগে বাবা জয়দেব জীবিত থাকা অবস্থায় কমলা দেবীর বিয়ে হয় বর্তমান বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার দেহেরগাতি গ্রামের ঊষাপতির পুত্র বলভদ্র বসুর সঙ্গে। রাজা জয়দেব তার মেয়ে দেবী কমলা ও জামাই বলভদ্র বসুর বাসস্থানের জন্য বর্তমান পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা উপজেলার কালারাজা গ্রামে বিশাল রাজপ্রাসাদ তৈরি করে দেন।
বলভদ্র বসুর গায়ের রং ছিল কালো। তাই তিনি মানুষের কাছে কালারাজা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।যদিও শিক্ষা, সমরবিদ্যা, ন্যায়বিচার, জনকল্যাণসহ নানা গুণে কালারাজা ছিলেন গুণান্বিত।
রাজা জয়দেবের মৃত্যুর পর রাজ্যের ক্ষমতা গ্রহণ করে রানী কমলা দেবী প্রজাদের পানীয়জলের কষ্ট নিবারণে বর্তমান বাউফল উপজেলায় ১০০ একর জমি নিয়ে বিশাল দীঘি খনন করেন। যা এলাকায় ‘কমলা রানীর দীঘি’ হিসেবে আজও স্মৃতি বহন করছে। এছাড়া তিনি অনেক পুকুর ও স্থাপনা নির্মাণ করেন।
চন্দ্রদ্বীপ আমলে এভাবে দুই হাজারের বেশি দীঘি খনন করা হয়। পাশাপাশি অন্যান্য স্থাপনা তো রয়েছেই। কালারাজা বিলের রাজপ্রাসাদ ও দীঘিসহ সেসব দর্শনীয় স্থাপনার আজ অনেক কিছুরই অবশিষ্ট নেই। ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, সুনামি সেসব স্মৃতির অধিকাংশই বিলীন করে দিয়েছে।
যেভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেছে কালারাজার রাজপ্রাসাদ। ভূমিকম্প ও সুনামিতে পুরো রাজপ্রাসাদ মাটির নিচে তলিয়ে গেছে। সেখানে সৃষ্টি হয় বিশাল বিলের। কালক্রমে যা আবাদি জমিতে রূপ নেয়। পরবর্তীতে গড়ে ওঠে জনপদ সমৃদ্ধ বর্ধিষ্ণু গ্রাম। তৈরি হয় ঘরবাড়িসহ রাস্তাঘাট, স্কুল, মাদ্রাসাসহ নানা প্রতিষ্ঠান। কালারাজার স্মরণেই গ্রামটিরও নাম হয় কালারাজা।
রানী কমলা দেবীর শাসন আমলের মধ্যবর্তী কোনো একসময় এই "কালারাজা" গ্রামটিকে কেন্দ্র করে কমলা কান্ত খালের কোল ঘেঁষে গড়ে উঠে "কালারাজা বাজার" যা আজ কালের সাক্ষী হিসাবে দাড়িয়ে আছে।
রাজ প্রথা বিলুপ্তির পরবর্তী সময়ে ও যুগ-যুগ ধরে এই বাজারকে কেন্দ্রকরে অত্র অঞ্চলের গ্রামীণ অর্থনীতি পরিচালিত হতো। বহু দূর-দূরান্ত থেকে বণিক /ব্যাবসায়ীরা বড় - বড় নৌকা জাহাজ যোগে বাণিজ্যের উদ্দেশে এই বাজারে আসতেন।
যা এখন কর্মমুখর কালারাজা নামের গ্রাম। কিন্তু সেখানে কোথাও মেলে না কালারাজার রাজপ্রাসাদের চিহ্ন। তবে প্রবীণদের কেউ কেউ পূর্বসূরিদের উদ্ধৃতি দিয়ে জানান, উনিশ শতকের শুরুতে যখন বাড়িঘরসহ নানা স্থাপনা গড়ে উঠতে শুরু করে, তখন মাটি খুঁড়লেই মিলত প্রাচীন আমলের ইট। এখনও খোঁড়াখুঁড়ি করা গেলে সে ধরনের নিদর্শনের দেখা মিলবে বলে মনে করেন অনেকেই।
কালের বিবর্তনে ঐতিহাসিক চিহ্ন বিলীন হয়ে গেলেও এতদাঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে এখনও রাজকুমারী কমলা দেবীকে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের গান, গল্প, কবিতা, পুঁথি প্রচলিত আছে। ছড়িয়ে আছে নানা কিংবদন্তি। বিশেষ করে শত শত বছর ধরে কমলার গান জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিল।
পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলা সদর থেকে চিকনিকান্দি হয়ে, বাইকে বা পিকাপ যোগে মাত্র ২০ মিনিটের পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় কালারাজার বাজারে।
পটুয়াখালী সদর থেকে সেহাকাঠী -ধরান্দী। বা, ইসলামপুর-ধরান্দী বাজার হয়ে কালারাজা বাজারে আসাযায় সহজেই।
কালারাজা বাজারে সপ্তাহে ৩ দিন (শুক্রবার , রবিবার ও বুধবার )গ্রামীণ হাট বসে। এই হাটে গ্রামের টাটকা শাক-সবজি , খাল-বিল ও নদীর তাজা মাছ সহ নিত্য প্রয়জনীয় সবরকমের জিনিস-পত্র পাওয়াযায়। এ ছাড়াও কালারাজা বাজারে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত সব দোকান খোলা থাকে এবং নিত্য প্রয়জনীয় সবকিছুই পাওয়াযায়।